(দোলের ওপার থেকে অংশটি দুটো ভাগ আছে। বেশী বড়ো হয়ে গেলে পড়তে অসুবিধে হতে পারে, তাই দুটো পার্টে দিলাম। পুরো টা ম্যাডাম কাহনের পেজে নোটসে আসছে। লেখার কিছু কিছু অংশের জন্য তাপসদা, তাপসকুমার লায়েক দায়ী)

ম্যাডাম কাহন ও awe-me (দোলের ওপার থেকে-ক) অচিঠি অংশ-

বহুদিনের অভ্যেস, ভোর সাড়ে চারটের সময় ঘুমটা আলতো হয়ে যায় লেখা ম্যাডামের। তারপর হাতটা নিজের চোখ বন্ধ রেখে হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছে যায় মোবাইলটার কাছে, এও এক বহু আগেকার স্বভাব। বহু বহু আগেকার। চোখটা বন্ধ রেখে আন্দাজে মোবাইলটা চোখের সামনে এনে তারপর দেখার দরজা খোলা হবে ওনার। চোখের সামনে কি থাকবে ওনার জানা, একটা মেসেজ লেখা “গুড মর্নিং ম্যাডাম। নতুনের খুব দিন হোক আজ। ইনবক্সে যাবেন কিন্তু, কেউ একটা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য”। এটা দেখলেই মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যেত কাহনের। আস্তে আস্তে মেলের ইনবক্স খুলে দেখতো, আর সে সব কি বিচিত্র নাম ওগুলোর। কোনোটার নাম “গগনে খুব পিঁপড়ে হয়েছে”, কখনো “এটা সবচেয়ে জরুরী কোনো কথা” কখনো “তুই তো পড়বি না, নিজের জন্যই লিখছি”। অন্যমনস্কের ওপরে তখন রশ্মি পড়ছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে একটা ট্রেন ঢিংকাচিকা ঝিকিমিকি ঢিংকাচিকা ঝিকিমিকি করতে করতে বেরিয়ে গেল। এটাই ভাবতেই ফিক করে হেসে ফেললেন ম্যাডাম, পথের পাঁচালীর ওই অক্রূর সংবাদ অংশটা মনে পড়লো। ট্রেনে প্রথমবার উঠে অপু আবিষ্কার করেছিলো ট্রেন চলতে শুরু করলে যে আওয়াজটা হয় সেটা শুনতে লাগে “বটঠাকুরপো ছোটঠাকুরপো। বটঠাকুরপো ছোটঠাকুরপো।” ওটিও এই ক্ষ্যাপামশাই এর নির্ঘাৎ কেউ ছিলো। হাসির মধ্যে থেকেই ফোনের ভেতরটা খাঁ খাঁ দেখে দুম করে কয়েকটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল ম্যাডামের। কতোবার কতো কতো বার দুম করে কথা বন্ধ করে দিতেন, কোনো কিছু লিখতেন না, আর বাচ্চাটা রেগেমেগে কতো কি লিখতো। আর প্রতিবার খুব গম্ভীরভাবে, “এটাই শেষ চিঠি”, “আর কখনো লিখবো না”, “এই চললাম”, হাহাহাহা।

ভাবতে ভাবতে ট্যুইক করে ডেকে উঠে একটা শালিখের পেছনে আরেকটা শালিখ শোঁ শোঁ করে বেরিয়ে গেল। ম্যাডামের হাসির ভেতর একটা ঠোঁট হঠাৎ একটু তিরতির করে কেঁপে উঠলো, একটা টান ধরলো চোখের ভেতরে। কি কঠি কথাটাই না লিখেছিলেন, কেন লিখেছিলেন, “শোনো, যারা ওই যাই, যাচ্ছি, চললাম বলে না তারা যায় না। যারা সত্যি যাওয়ার তারা চলে যাওয়ার অনেক পর বুঝতে পারে লোকে যে তারা নেই”। থম মেরে গেছিলো ও ছোটু ঝাঁকড়া চুলোটার মুখটা, ঠোঁটটাও কি ফুলেছিলো একটু? আহা রে, এত কঠিন কথা কেন বললেন? উনি কি জানতেন না এই ক্ষ্যাপা সর্দারের ছাত্রী, বন্ধু, প্রেমিকা, আদর বা আবদারের ঠিকানা সবকিছুই তো ছিলেন উনি। কবেই বা ও হুঁশে থাকতো, সারাক্ষনই অদ্ভুতুড়ে লেখায়, কিম্ভূত ভাবনায় মেতে রয়েছে। আর তা সত্ত্বেও সারাক্ষন কি ভীষণই না আগলে রাখতো তাঁকে, রাত্রে সব শেষে ওই ঝাঁকড়া মস্তানের বুকের মধ্যে গুটিয়ে শুয়ে পড়লে কি নরম হয়ে যেত পৃথিবী। আর ওনার তো চোখে ঘুম বলে বস্তু কিছু ছিলো না, তাই সারারাত্রি ওরক আগলে ধরে রাখতো ক্ষ্যাপামশাই। কখনো ঘুম ভাঙলে হঠাৎ তাকালে আবিষ্কার করতেন কি অদ্ভুত স্নিগ্ধ একট দৃষ্টি সারা গায়ে কোমল জাজিমের মতো এসে পড়েছে। সেই দেখাটার ছোঁয়া শরীরে সর্বত্র বোঝা যাচ্ছে, সমস্ত নরমে সমস্ত গহনে সমস্ত অন্তরাঞ্চলে তার পা টিপে টিপে। কোনো এক অকারন শিহরে হঠাৎ সমস্ত কেঁপে উঠতো।

-“কি হলো রে ভূতো? হিহিহিহি, ভয় পেলি কিছুতে?”

জড়ানো ঘুমের গলায় “উঁ উঁ উঁ উঁ নাহহহহহহ। কিইইইইইইইচ্ছু হয়নি। হয়য়য় নি। তুমি জেগে আছো কেন? ঝাঁকড়া বুনো আফ্রিকা একটা। যাচ্ছেতাই আফ্রিকা। আমার আমাজন কোথায়?”

বলতে বলতে পাশ ফিরে ঘুমের আধখাওয়া ঘোরে দু হাত বাড়িয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরতেন মানুষটার। লোকটা না একটা কি যেন!! এটা আপনমনে ভেবে আর সরে আসতেন কাছে আর নিজের মাথাটা আস্তে আস্তে নামিয়ে দিতেন ওই কালো-বাদামী বুকটার ওপরে। যার ভেতরে উনি নিশ্চিত একটা মস্তো খরগোশ থাকে। আহা, লোকটার বুকে কি অপার শান্তি ছিলো এক। অমন দামাল ক্ষ্যাপা উন্মাদ মানুষটার, বাইরে থেকে কক্ষনো বুঝতে পারবে না তুমি, তার বুকের মধ্যে যেন মিশকালো পদ্মসায়রের জল টলটল করছে। খুব ছোঁয়া নিতে নিতে আবার ঘুমের ঢল নেমে আসতো তাঁর। পলক জড়িয়ে যাওয়ার ঠিক আগে আগে কানে আসতো

ঘুমের মধ্যেই ফিক করে হাসি পায়। শুনতে পান বলছে, “ঘুমো, ঘুমো বলছি। দাঁড়া একটা লেখা বলি শুনতে শুনতে ঘুমো।” খুব আদুরে হয়ে ঘনিয়ে আসেন দু হাতে গলাটা জড়িয়ে। আর কোন এক মন্ত্রমৃদুলের মতো গলায়, দূর থেকে ভেসে আসে

“কুয়াশায় ডুবন্ত আঙুল কি জানে কোনখানে কাহনের পাড়? ...... যেখানে যাবার সে কি জানে সেথা চুল সর্বদা বৃষ্টিমুখর... যে ইশারা আমায় বালায় মাখামাখি তাকে আমি গেঁয়োমূখ্যুভূত কি দিয়ে জড়াবো... কাজলঝালরে আমি বৈঠা নিয়ে যাবো...... এইবারে উঠে পড়ো, ডায়েরী কলম ও ভ্রমর নিয়ে আমার ওপরে...... ও পাগলী ময়ুরের ছটফটে আমারওতো খুব এসে যায়... অক্ষর ভিজে গেলে তোমার, তাকে নদি এসে ঠিক তুলে নেবে......

“এখনো আসে না দেখি ভূতের কোনে ঘুম...... এখনো আসে না সেই চ্ছলাৎ হরফগুলো বুঝি?...... তুই কি ক্লান্তিতে অগোছালো খুব? ঘুম বুঝি মৃদু মৃদু তুলোদের কোলে খুব ম্লান হয়ে আছে? ...... তাহলে ডাকছি তাকে দাঁড়া খুব ডাকু ডাকু করে...... তরল ডানার দোলে আমি তোকে হাওয়া দিয়ে যাবো...... অথবা তোর চুলে ছিপ ফেলে বসে থাকবো সারারাত... আর ঘুম ভাঙা মুক্তোটি দেখলে বলে দেবো, যতো আদর এসেছিলো সব লিখে রেখেছি হরিণের মুখে...”

গান নয়, আবৃত্তি নয়, এগুলো যে কি ম্যাডাম নিজেও জানেন না। শুধু জানেন এরকম ও অনর্গল বলে যেতে পারে বুক দিয়ে আগলে রেখে তাঁকে। শুনতে শুনতে ঘুমের ভীষণ ভেতরে যে ঘুমালি সায়র, তাতে ধীরে ধীরে ডুবে যান ম্যাডাম। এভাবে কি ঘুম পাড়ায় কেউ? লোকটা না একটা যা তা। ভাবতে ভাবতে নক্ষত্রের শিশিরেরা নেমে আসে মনে। এমন দৃশ্যের কাছে কি কখনো হিংসা, ঈর্ষা, কৌশল, চাতুরী, কপট এইসব শব্দরা বেঁচে থাকতে পারে?