praharasm

(দোলের ওপার থেকে অংশটি দুটো ভাগ আছে। বেশী বড়ো হয়ে গেলে পড়তে অসুবিধে হতে পারে, তাই দুটো পার্টে দিলাম। পুরো টা ম্যাডাম কাহনের পেজে নোটসে আসছে। লেখার কিছু কিছু অংশের জন্য তাপসদা, তাপসকুমার লায়েক দায়ী)

ম্যাডাম কাহন ও awe-me (দোলের ওপার থেকে-ক) অচিঠি অংশ-

বহুদিনের অভ্যেস, ভোর সাড়ে চারটের সময় ঘুমটা আলতো হয়ে যায় লেখা ম্যাডামের। তারপর হাতটা নিজের চোখ বন্ধ রেখে হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছে যায় মোবাইলটার কাছে, এও এক বহু আগেকার স্বভাব। বহু বহু আগেকার। চোখটা বন্ধ রেখে আন্দাজে মোবাইলটা চোখের সামনে এনে তারপর দেখার দরজা খোলা হবে ওনার। চোখের সামনে কি থাকবে ওনার জানা, একটা মেসেজ লেখা “গুড মর্নিং ম্যাডাম। নতুনের খুব দিন হোক আজ। ইনবক্সে যাবেন কিন্তু, কেউ একটা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য”। এটা দেখলেই মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যেত কাহনের। আস্তে আস্তে মেলের ইনবক্স খুলে দেখতো, আর সে সব কি বিচিত্র নাম ওগুলোর। কোনোটার নাম “গগনে খুব পিঁপড়ে হয়েছে”, কখনো “এটা সবচেয়ে জরুরী কোনো কথা” কখনো “তুই তো পড়বি না, নিজের জন্যই লিখছি”। অন্যমনস্কের ওপরে তখন রশ্মি পড়ছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে একটা ট্রেন ঢিংকাচিকা ঝিকিমিকি ঢিংকাচিকা ঝিকিমিকি করতে করতে বেরিয়ে গেল। এটাই ভাবতেই ফিক করে হেসে ফেললেন ম্যাডাম, পথের পাঁচালীর ওই অক্রূর সংবাদ অংশটা মনে পড়লো। ট্রেনে প্রথমবার উঠে অপু আবিষ্কার করেছিলো ট্রেন চলতে শুরু করলে যে আওয়াজটা হয় সেটা শুনতে লাগে “বটঠাকুরপো ছোটঠাকুরপো। বটঠাকুরপো ছোটঠাকুরপো।” ওটিও এই ক্ষ্যাপামশাই এর নির্ঘাৎ কেউ ছিলো। হাসির মধ্যে থেকেই ফোনের ভেতরটা খাঁ খাঁ দেখে দুম করে কয়েকটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল ম্যাডামের। কতোবার কতো কতো বার দুম করে কথা বন্ধ করে দিতেন, কোনো কিছু লিখতেন না, আর বাচ্চাটা রেগেমেগে কতো কি লিখতো। আর প্রতিবার খুব গম্ভীরভাবে, “এটাই শেষ চিঠি”, “আর কখনো লিখবো না”, “এই চললাম”, হাহাহাহা।

ভাবতে ভাবতে ট্যুইক করে ডেকে উঠে একটা শালিখের পেছনে আরেকটা শালিখ শোঁ শোঁ করে বেরিয়ে গেল। ম্যাডামের হাসির ভেতর একটা ঠোঁট হঠাৎ একটু তিরতির করে কেঁপে উঠলো, একটা টান ধরলো চোখের ভেতরে। কি কঠি কথাটাই না লিখেছিলেন, কেন লিখেছিলেন, “শোনো, যারা ওই যাই, যাচ্ছি, চললাম বলে না তারা যায় না। যারা সত্যি যাওয়ার তারা চলে যাওয়ার অনেক পর বুঝতে পারে লোকে যে তারা নেই”। থম মেরে গেছিলো ও ছোটু ঝাঁকড়া চুলোটার মুখটা, ঠোঁটটাও কি ফুলেছিলো একটু? আহা রে, এত কঠিন কথা কেন বললেন? উনি কি জানতেন না এই ক্ষ্যাপা সর্দারের ছাত্রী, বন্ধু, প্রেমিকা, আদর বা আবদারের ঠিকানা সবকিছুই তো ছিলেন উনি। কবেই বা ও হুঁশে থাকতো, সারাক্ষনই অদ্ভুতুড়ে লেখায়, কিম্ভূত ভাবনায় মেতে রয়েছে। আর তা সত্ত্বেও সারাক্ষন কি ভীষণই না আগলে রাখতো তাঁকে, রাত্রে সব শেষে ওই ঝাঁকড়া মস্তানের বুকের মধ্যে গুটিয়ে শুয়ে পড়লে কি নরম হয়ে যেত পৃথিবী। আর ওনার তো চোখে ঘুম বলে বস্তু কিছু ছিলো না, তাই সারারাত্রি ওরক আগলে ধরে রাখতো ক্ষ্যাপামশাই। কখনো ঘুম ভাঙলে হঠাৎ তাকালে আবিষ্কার করতেন কি অদ্ভুত স্নিগ্ধ একট দৃষ্টি সারা গায়ে কোমল জাজিমের মতো এসে পড়েছে। সেই দেখাটার ছোঁয়া শরীরে সর্বত্র বোঝা যাচ্ছে, সমস্ত নরমে সমস্ত গহনে সমস্ত অন্তরাঞ্চলে তার পা টিপে টিপে। কোনো এক অকারন শিহরে হঠাৎ সমস্ত কেঁপে উঠতো।

-“কি হলো রে ভূতো? হিহিহিহি, ভয় পেলি কিছুতে?”

জড়ানো ঘুমের গলায় “উঁ উঁ উঁ উঁ নাহহহহহহ। কিইইইইইইইচ্ছু হয়নি। হয়য়য় নি। তুমি জেগে আছো কেন? ঝাঁকড়া বুনো আফ্রিকা একটা। যাচ্ছেতাই আফ্রিকা। আমার আমাজন কোথায়?”

  • “হিহিহিহি, ঘুমের মধ্যেও আমাজন চাই। বাব্বাহ। আমাজন আছে, আমাজন আছে। ঠিক আছে। আপনি যখন চাইবেন তখনই সে ঝড়ের জামা পরে নিজের ম-অ-অ-স্তো জংলা সহ লক্ষ ঘোড়ার খুরে ছুটে যাবে আপনার ওপর দিয়ে। এখন ঘুমোন”

  • “তুমি জেগে আছো কেন? বলো বলো। জেগে আছো কেন? ঘুমোওনি কেন?”

বলতে বলতে পাশ ফিরে ঘুমের আধখাওয়া ঘোরে দু হাত বাড়িয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরতেন মানুষটার। লোকটা না একটা কি যেন!! এটা আপনমনে ভেবে আর সরে আসতেন কাছে আর নিজের মাথাটা আস্তে আস্তে নামিয়ে দিতেন ওই কালো-বাদামী বুকটার ওপরে। যার ভেতরে উনি নিশ্চিত একটা মস্তো খরগোশ থাকে। আহা, লোকটার বুকে কি অপার শান্তি ছিলো এক। অমন দামাল ক্ষ্যাপা উন্মাদ মানুষটার, বাইরে থেকে কক্ষনো বুঝতে পারবে না তুমি, তার বুকের মধ্যে যেন মিশকালো পদ্মসায়রের জল টলটল করছে। খুব ছোঁয়া নিতে নিতে আবার ঘুমের ঢল নেমে আসতো তাঁর। পলক জড়িয়ে যাওয়ার ঠিক আগে আগে কানে আসতো

  • “আমি জেগে আছি কেন? আসলে আপনার তো চারদিকে কোনো বেড়া নেই। আর আপনার ঘুমন্তখানি যে কি কচি কলাপাতা রঙের আপনি ভাবতেও পারবেন না। যদি কখনো হঠাৎ ছাগলেরা ঢুকে যদি কচর মচর করে খেয়ে যায়? আপনার ঘুমটি পাহারা দিচ্ছি আমি।”

ঘুমের মধ্যেই ফিক করে হাসি পায়। শুনতে পান বলছে, “ঘুমো, ঘুমো বলছি। দাঁড়া একটা লেখা বলি শুনতে শুনতে ঘুমো।” খুব আদুরে হয়ে ঘনিয়ে আসেন দু হাতে গলাটা জড়িয়ে। আর কোন এক মন্ত্রমৃদুলের মতো গলায়, দূর থেকে ভেসে আসে

“কুয়াশায় ডুবন্ত আঙুল কি জানে কোনখানে কাহনের পাড়? ...... যেখানে যাবার সে কি জানে সেথা চুল সর্বদা বৃষ্টিমুখর... যে ইশারা আমায় বালায় মাখামাখি তাকে আমি গেঁয়োমূখ্যুভূত কি দিয়ে জড়াবো... কাজলঝালরে আমি বৈঠা নিয়ে যাবো...... এইবারে উঠে পড়ো, ডায়েরী কলম ও ভ্রমর নিয়ে আমার ওপরে...... ও পাগলী ময়ুরের ছটফটে আমারওতো খুব এসে যায়... অক্ষর ভিজে গেলে তোমার, তাকে নদি এসে ঠিক তুলে নেবে......

“এখনো আসে না দেখি ভূতের কোনে ঘুম...... এখনো আসে না সেই চ্ছলাৎ হরফগুলো বুঝি?...... তুই কি ক্লান্তিতে অগোছালো খুব? ঘুম বুঝি মৃদু মৃদু তুলোদের কোলে খুব ম্লান হয়ে আছে? ...... তাহলে ডাকছি তাকে দাঁড়া খুব ডাকু ডাকু করে...... তরল ডানার দোলে আমি তোকে হাওয়া দিয়ে যাবো...... অথবা তোর চুলে ছিপ ফেলে বসে থাকবো সারারাত... আর ঘুম ভাঙা মুক্তোটি দেখলে বলে দেবো, যতো আদর এসেছিলো সব লিখে রেখেছি হরিণের মুখে...”

গান নয়, আবৃত্তি নয়, এগুলো যে কি ম্যাডাম নিজেও জানেন না। শুধু জানেন এরকম ও অনর্গল বলে যেতে পারে বুক দিয়ে আগলে রেখে তাঁকে। শুনতে শুনতে ঘুমের ভীষণ ভেতরে যে ঘুমালি সায়র, তাতে ধীরে ধীরে ডুবে যান ম্যাডাম। এভাবে কি ঘুম পাড়ায় কেউ? লোকটা না একটা যা তা। ভাবতে ভাবতে নক্ষত্রের শিশিরেরা নেমে আসে মনে। এমন দৃশ্যের কাছে কি কখনো হিংসা, ঈর্ষা, কৌশল, চাতুরী, কপট এইসব শব্দরা বেঁচে থাকতে পারে?

লেখা ম্যাডামের প্রথমিয়া-

কোনো একটা শীত গুটোনো নন বসন্ত সময়ের কথা বলা হচ্ছে। পৃথিবীতে তখনো মুকুলস্কুলের ছুটি হয়নি আমগাছে। বছরটাকে যেকোনো কিছু ধরে নিতে পারেন। এই ২০১৭ ধরুন কি ১৯৮৭ কি ২০২৭ ধরা যাক, কেমন। লেখা, হয়তো পুরো নামটা স্মৃতিলেখা বা বিদ্যুতলেখা বা হয়তো সম্পূর্ণ অন্য কিছুই হতে পারে, তবে এখানের সবাই তাঁকে লেখা ম্যাম বলেই জানে, স্নান করে বেরিয়ে হুম হুম গুব গুব করতে করতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। একেবারেই আনমন ও উদ্দেশ্যহীন। এই গানের বদলে হুম হুম গুব গুব বা অন্যান্য মজার মজার শব্দ করতে দারুণ লাগে তাঁর, যখন কেউ নেই চারপাশে, পাশের চারদিকে কেউ নেই, শ্রোতা হিসেবে একটা নিঃসঙ্গ দিন ওনাকে ভেতরে ঢুকিয়ে অতিকায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা দিনের কাছে লজ্জা কি? দিনটাতো তাঁর স্নানও দেখেছে, স্নানের সোহাগও দেখেছে একায় এবং একায়, পোশাক পরতেও দেখেছে, খুলতেও দেখেছে, ঘুমের শব্দ থেকে স্নানের শব্দ থেকে সোহাগের শব্দ, সবই তো শুনেছে দিন। ওর কাছে আর কি লজ্জ্বা। তাই এই সময়টা একটানা নানান কথা বলে যান লেখা, কতো কথা, সব যে বলার মতো তা নয় কিন্তু। না না বলার মতো নয় বলতেই যে সব কথার কথা মাথায় আসে তা নয়। কিছু আজগুবি শব্দ ওই গুবগুবের মতো, কিছু এমনি চেনা শব্দ উলটে মুড়ে যাওয়া। এই যেমন অল্প আগে বলছিলেন “অননে লাগে খুব তুমি অঘন অঘন হও। হনিতিপর্ণা নিও বিনুহা পিপলে”, এগুলি বলার মতো কথা? হা হা হা। তাই এই সব স্রোতের মতো বলে যেতে ভারি ভালো লাগে তাঁর। বিশেষতঃ স্নানের পরে। সামান্য দু মুঠো ফুটিয়ে নিতে হবে নিজের জন্য। রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে আবার পদক্ষেপের মধ্যেই অন্যমন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন সরু কড়িডোরটাতে। একফালি করিডোর যা বেডরুমের বাইরে থেকে রান্নাঘরের বাহির অবধি বিস্তৃত। তার ওইপাশে বাড়িটার পেছনের উঠোন। সেখানে অগোছালো শিশুর মতো কিছু গাছ হেতাসেথা ছড়িয়ে রয়েছে। একটা কাগজী লেবু গাছ, সর্বদা গর্ভবতী হয়ে থাকে। লেবুতে লেবুতে একাকার। বেচারা লেবুফুলগুলো একটিও জীরোনোর সময় পায় না বোধহয়। লেখা ম্যাডাম আপনমনে মুচকি হেসে ওটার দিকে তাকিয়ে বললেন “আচ্ছা প্রেম হয়েছে মৌমাছিদের সাথে যা হোক। এত পীরিত আর ওদেরকে একটু প্রিকশান নিতে বলতে পারিস না। আরে কন্ডোম পরতে বললে কি তাদের মধু চলে যাবে নাকি?” বলেই আপনমনে ফিক করে হেসে ওঠেন। উফ আচ্ছা সব ভাবনা চিন্তা আসে বটে মাথায়। লেবুগাছটার পাশে একটা মোটকা মতো পেঁপে গাছ আছে। বড্ডো বড্ডো বেচারা বেচারা দেখতে। মনে হয় যেন সারাক্ষণ ভয়ে আছে কেউ তাকে ভেঙে ফেলবে। বিকেলবেলা তো লেখা ম্যাডাম দেখেছেন ও ভারি গুটিসুটি মেরে কাঁদে ওর পাতাগুলো। ওর দিকে তাকিয়ে বলেন “অতো ভয় কিসের? আমি আছি না, কেউ তোকে ভাঙবে না”। করিডোরটায় একটা ত্যারচা রোদ্দুর বৃত্ত এঁকে পড়ে আছে পায়ের সামনে। লেখা ম্যাডাম তাকে বলেন “সর, সর এখান থেকে, আমি যাবো এখন। ভাত চাপাতে হবে। কাজ নেই কম্মো নেই এখন এসে পড়ে আছেন পায়ের সামনে। এখনই ওনাকে আদর করতে হবে। উফফফ পারি না বাবা।” যে কাঁঠালগাছটার দু ডালের ফাঁক দিয়ে কয়েকগোছা পাতার হাত ধরে ধরে ওইইইইই সেই কত্তো উঁচু সূর্য থেকে রোদটা স্লিপ খেয়ে এসে কোনোমতে সামলে সুমলে এসে পড়েছে লেখা ম্যাডামের করিডোরে। সেই গাছের পাতাগুলো একটা অকারণ হাওয়ায় হঠাৎ কেঁপে ওঠে আর তার সাথে রোদটাও নিজের গায়ের ছায়ার নকশাগুলোকে কাঁপিয়ে দেয়। লেখা ম্যাডামের মনে হয় যেন ওনার কথা শুনে ওই একফোঁটা বৃত্তরোদখানি ফুঁপিয়ে উঠেছে। আহা রে, উবু হয়ে বসে তার গায়ে হাত দেন লেখা ম্যাডাম। ভেজা আঙুলগুলো সামান্য হাল্কা উষ্ণ লাগে। রোদটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন “দূর বোকা, আমি তোকে সরে যেতে বলেছি বলে এভাবে কাঁদতে হয়? কক্ষনো না। তুই না রোদ, তুইসবসময় হাসবি বুঝলি” আবার এক অকারণ হাওয়ায় কাঁঠালপাতা কাঁপে আর রোদটাও ঝিরিঝির করে ওঠে। “হ্যাঁ এরকম হাসবি বুঝলি? কে যানে নৌকোয় মাঝি মঞ্জির মঞ্জির করছে কেন। স্নান করে মাথা মুছে সে যাবে বাজারে, যেখানে কাঁঠাল পাতায় রাখা আলতা কাজল আর কপালি বিক্রী হচ্ছে, সে কিনে নেবে। তারপর গোলূধি পার করে অন্য গোলার্ধ্বে যাবে ঝরঝরে দাঁড় টেনে টেনে। মাঝি আলতো আলতো উলুস হবে যে”। এরকমই অকাতর বাক্য বলে বলে লেখা ম্যাডাম নিজের চারপাশকে বড়ো অনাবিল করে রাখেন সবসময়। রোদও তার ব্যতিক্রম নয়। টের পান স্নানভেজা আঙুলটি যে বৃত্তাকার রোদের দাগে রেখেছিলেন করিডোর, সেটাতে উষ্ণস্পর্শ যেন আরেকটু সামান্য আঁট হয়ে বসে। রোদ কি বাড়লো অল্প? হা হা হা, নাহ, বুঝেছেন এর কীর্তি। “থাক থাক হয়েছে, আর আমার আঙুলে চুমু খেতে হবে না, তুই এখানে বসে থাক চুপচাপ আমি রান্না করে আসি কেমন? আমাকেও তো খেতে হবে নাকি? লেবুগাছ, কাঁঠালগাছগুলোর কি মজা বলতো, কয়েকগ্রাস তোকে খেলেই ওদের পেট ভরে যায়, খাটা খাটনি নেই, নড়া চড়া নেই, গপগপ করে তোদেরকে খাচ্ছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আর তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে আর রোজ প্রজাপতি মৌমাছিদের সাথে সোহাগী হয়ে আছে। আর পারি না বাপু”। রোদের ছাপটা যেন অতি অতি মৃদু কেঁপে ফিসফিস করে বলে ওঠে “তুমিও খাওনা আমাকে, তোমাকে কে বারণ করেছে?”। ম্যাডাম খিলখিল করে হেসে ওঠেন। মুখে হাত দিয়ে। “হিহিহিহিহি, ভালো বলেছিস, আমি তাই করি আর কি, রোজ স্নান করে দুপুরবেলা বাইরে গিয়ে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবো লাঞ্চ করছি। হিহিহিহিহিহি। আর রাত্রে কি খাবো শুনি? তুই আসবি রাত্রে? তোকে আসতে দেবে রাত্রে? রাতের অন্ধকার রোদ কোথাকার, হিহিহিহি”। ম্যাডাম সবার ভাষা বোঝেন, রোদ বলো, পিঁপড়ে বলো, মহা বেকুব হাওয়া ভুল করে জানলা দিয়ে ঢুকে অস্ফুটে “এ মা সরি সরি” বলে চোঁ চাঁ পালাতে গিয়ে একবার টেবিলে ধাক্কা, তারপর ড্রেসিং টেবিলে ধাক্কা তারপর ওদিকে ফ্রিজের মাথায় কয়েকটা লুজ স্টিকি উড়িয়ে “সরি সরি, ভেরি সরি” বলে দৌড়ে পালায় দরজা দিয়ে। ম্যাডাম হেসেই মরে যান দেখে, কি ভীতু হয় না হাওয়াগুলো। হাওয়া হতে গেলে ভারী ভীতু হতে হয়। রোদের পাশ থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে দু পা বাড়াতে পেছনের উঠোন দিয়ে মাটি ঘেঁষে, পড়ে থাকা কয়েকটা লেবুফুল উড়িয়ে কুঁচ কুঁচাইই কুঁচ কুঁচাইই কুঁচ কুঁচাইইই ডেকে তারপর ক্রিইইক করে শব্দ করে একটা মোটাসোটা শালিখ হুস করে উড়ে যায়। তার পেছন পেছন একটা রোগা শালিখ ওই একই ক্রিইইক শব্দ করে কুঁচাইইই কুঁচাইইই কুঁচাইইই শব্দ করে উড়ে যায়। ম্যাডাম থেমে গিয়ে দুই পলাতকার দিকে তাকিয়ে বলেন “আচ্ছা হয়েছে যা হোক দু মূর্ত্তি। একজন যা বলবে অন্যজন তার পোঁ ধরবে। এই যে এত পড়ি কি মড়ি করে দৌড়ে গেল কিসের জন্য? না ওই মাঠের পাশের মহানিম গাছটার এক্কেবারে মগডালে গিয়ে বসতে হবে ওনাদের। হঠাৎই কোনো কারন নেই। ওখানে দু জন বসবেন, দিয়ে কাঁইইচি কাঁইইইচি করে খানিকক্ষণ চেঁচাবেন, তারপর আবার খানিকক্ষণ বাদে আবার একইরকম হুড়মুড় করে দৌড়ে ফিরবেন এই উঠোনে। আর চুপচাপ মন দিয়ে মাটি থেকে পোকা খুঁটে খুঁটে খাবে। সত্যিইই। কালো রঙ তার আবার চোখে সাদা চশমা!! পারি না। কিম্ভূত পাখি কোথাকার”। টুপটুপ করে কথাগুলো বলে ম্যাডাম রান্নাঘরের ভেজানো দরজাটা ঠেলতে গিয়ে শুনতে পান বহু বহুউউউউ দূর থেকে কোনো একটা শ্রান্ত ক্লান্ত কোকিল ডাকছে কূউউউউউহুহু, কূউউউউহু, কূউউউউউউউউ, শেষেরটার হ যেন রোদ আর হাওয়ায় আর নিজের ক্লান্তিতে মিলিয়ে গেলো। লেখা ম্যাডামের এক মুহূর্ত্তে গুনগুন গুবগুব করে গেয়ে চলা কথাগুলো থেমে কোথায় কোন সে এক জগতে নিয়ে গিয়ে ফেললো তাঁকে। আদিবাসী কোকিল, এই শব্দদুটো মাথায় আসতেই এরকম সব থেমে কোন এক ঘূর্ণিতে ডুবে যাওয়া।

একটা সময় খুব মনে পড়ে ম্যাডামের। এই বাড়িটা ম্যাডামের একার ঘর। এখানে উনি ছাড়া আর কোনো মানুষ থাকে না। দেখা করতে আসে, সকালের দিকে লেখার তাগাদা দিতে সম্পাদকদের কেউ কেউ আসেন, কখনো কেউই আসে না। বিকেলে একদল বাচ্চা আসে, পোশাকী নাম আছে ওই পুটকুনগুলো এসে হইচই করার, বলা হয় “পড়তে আসে”। পড়া তো ঢের হয়, হয় হইচই, খচর মচর আর গল্প। ম্যাডাম গল্প বলতে ওস্তাদ, আর এই কাজটা ওনার খুউউউব ভালো লাগে, কাউকে সামনা সামনি গল্প শোনানোর। বিশেষতঃ এই কেলে কুলো পুটকুঙ্গুলোর মুখ যখন আস্তে আস্তে গোল গোল হয়ে ওঠে আর ডুবে যায় গল্পের ওঠা নামা এভাঁজ ওভাঁজে। কেউ একটা ফিসফিস করে বলে “তাপ্পর”। তখন ম্যাডামের মনে হয় যেন ওই শেষ বিকেলের লাল টুকটুকে সূয্যিটাকে নিজের কোলে নিয়ে বসে আছেন, আর লাল টুকটুকে সূয্যিটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ-আ-আ করে আছে। শুনছে তো শুনছে। পুঁচকে সূয্যিটার গা টা কি নরম। এটা তাঁর একার ঘর। তার মানে এই নয় যে তাঁর আর কেউ নেই। অনেকে আছে। ম্যাডামের বাড়িতে আছে, মানে ম্যাডামের ঘরে। খুব মিষ্টি একটা বর আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, কতোগুলো ভারি ন্যাওটা বাচ্চাও আছে। ওটা ম্যাডামের ঘর। আর এটা ম্যাডামের একার ঘর। নিজের একার এই ঘরে ম্যাডাম সপ্তাহে তিন চার দিন এসে থাকেন। ভারি ভালো থাকে মনটা। খুব গান গান একটা গন্ধে ভরে ওঠে। কিছুই করেন না, লেখেন, এমনি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান, আবার লেখেন, চিঠি লেখেন প্রচুর। এসব চিঠি কোথাও পাঠানোর জন্য নয়, এটাই ম্যাডামের এক অপূর্ব্ব রূপাভাস। এক একটা চিঠি লেখা শেষ হলে আয়নায় গিয়ে দেখেন ম্যাডাম নিজেকে। জিজ্ঞেস করেন “কি দেখছো?” আয়নার ভেতর থেকে হাসি ভাসে। ম্যাডামও হেসে ফেলেন খুব। “পড়লে?”, “হুঁউউ, পড়লাম”। “কিছু বললে না?”। আয়নাটা ভারি গম্ভীর হয়ে গেছে আজকাল। মাঝে মাঝে ছদ্ম ধমক দেন “দেখো তোমাকে আমি এইবার বেলজিয়ান গ্লাসে বাঁধিয়ে আনবো, চুপ থাকা বেরিয়ে যাবে তখন। একটাও বাংলা কথা বুঝবে না”। আয়নার ভেতরের ম্যাডাম যেন শেষটুকু উচ্চারণ করে ফিক করে হেসে ফেলেন “একটাও বাংলা কথা বুঝবে না, হি হি।” কখনো কখনো কিছু চিঠি আবার মুখে মুখেই লিখে যান ম্যাডাম। একটানা জলস্রোতের মতো। সে সব দামাল চিঠির সময়। তখন আয়নায় তাঁর কটাক্ষ চাহনি ভেসে ওঠে। হয়তো শীতের দুপুরে স্নানে যাওয়ার আগে শরীরের ওপর যা কিছু নির্মিত, যা কিছু নির্মান রাখা আছে, সরিয়ে রাখছেন এক এক করে। এই গেল টুপি, এই গেল সোয়েটার, এই আরেক সোয়েটার, এই টি শার্ট নীল। আয়নায় চোখ পড়ে, ভ্রু কুঁচকে ছদ্ম রাগের ভঙ্গিতে বলেন “কি দেখছো কি? চোখ বন্ধ রাখতে পারো না?” বলেই নিজেই চোখ বন্ধ খিলখিল করে হেসে দু পাক ঘুরে নেন ঘরে। বাইরে কোথাও একটা তখন ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং করতে করতে একটা সাইকেল চলে যায়, দূর ওই রেললাইনের থেকে ট্রেনটার ঝিকিঝিকি শোনা যায়। চলে যাওয়া ট্রেন দেখতে, বিশেষতঃ ব্রিজের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে যে ট্রেন। ঝিংকা ঝিকাং ঝিক্কি ঝিকাং। ঝিংকা ঝিকাং ঝিক্কি ঝিকাং। আওয়াজটা শুনলেই ম্যাডামের পৃথিবীতে কোথাও আর কিছু নেই, পৃথিবীতে কোনো যাওয়ার জায়গা নেই, পৃথিবীতে কোনো স্মৃতি নেই, ভবিষ্যৎ নেই, মনে পড়া নেই, মনে করা নেই, যা আছে তা শুধু এক ব্রীজের ওপর দিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া। এই অসম্ভব ভালোলাগাটার কথা কাউকে বলেননি ম্যাডাম। এমনিই ওনার বলার স্বভাব কম। নিজেকে রহস্যে মুড়ে রাখা লেখিকা বলেই পরিচিত সর্বত্র। সর্বত্র মানে অল্প যে পাঠকগোষ্ঠী আছে ওনার, খুবই নিবেদিত ডেডিকেটেড পাঠকগোষ্ঠী যারা অপেক্ষা করে কবে ম্যাডামের নেক্সট লেখা বেরোচ্ছে। তারা কেউই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। জানার মতো কিছু নেইও মনে করেন ম্যাডাম। আর যা জানানোর তা তো ওনার লেখার মধ্যেই থাকে। যার দেখার সে ঠিক দেখতে পাবে। সে কখনো জিজ্ঞেস করবে না এসে, এই দেখলাম ম্যাডাম, এটা কি ঠিক। হিহিহিহি। কোথেকে কোথায় না চলে যায় ভাবনা। কি ভাবছিলেন যেন? ব্রীজের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ট্রেন। কি অলৌকিক এই দৃশ্য আর তার দূরাগত শব্দ। জানলে হয়তো লোকে বলবে অপু-দুর্গা নকল করে আঁতেল সাজা হচ্ছে। কি করে বোঝাবেন ম্যাডাম, একটা ট্রেন ব্রীজের ওপর দিয়ে যখন চলে যায়, নির্লিপ্ত নিরাসক্ত নির্মোহ এক দুলুনিতে, তার সাথে কতো কি লেগে থাকে!! তার মধ্যে কতো হাজার না গল্প!! কতো লোককে সে নিয়েছে তার পেটে, সবাই চলেছে কোথাও না কোথাও। সবার যাওয়ার সাথে একটা না একটা গল্প লেগে আছে। ওই যে তিন নম্বর কামরাটার ভেতর হয়তো একটা বিহারী যুবক আপনমনে গুনগুন করছে “ক্যা হোগলবা রে বহতনিয়া… হো ক্যা হোগলবা রে…… হায় হায় হায় ক্যা হোগলবা রে থোড়া ধীরে সে…ধীরে সে… কহতনিয়া”। তার গানের ভেতর কয়েকশো কিমি দূরে তার বৌ মেটে সিদুঁর ধ্যাবড়া করে পরে তখন তালে তালে শিলনোড়ায় ডাল বাটছে। বা ছেলেটার উল্টোদিকে যে প্রবীণ অল্প কথা বলা, পাকা চুল লোকটা বসে আছে, সে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছে। আপনমনে ভাবছে তার চিড়িয়ারাণী ফুটফুটে কি ভালোটাই না বাসতো এই ট্রেনে জানলার ধারে বসতে। হয়তো সামান্য ছলছল করে উঠছে তার পৃথিবীর বহু ধুলো মাটি ঘষা খাওয়া পোড় খাওয়া খসখসে চোখদুটো। এসব ম্যাডাম দেখতে পান যখনই একটা ট্রেন চলে যায় ব্রিজের ওপর দিয়ে। তাঁর নিজের একার ঘরে যখন থাকেন, তখন ট্রেনের দূরাগত হুইশিল শুনলেই সোজা ছাদে চলে যান। তারপর খালি মগ্ন থেকে মগ্নতর হয়ে যাওয়া। ট্রেনটা যায়। ম্যাডামের ভাবতে খুব মানে খুউউউব ভালো লাগে যে এই যে তিনি দূর থেকে দেখছেন ট্রেনটাকে, তার চলা দোলন, ওঠানামা, ট্রেনটা তার কিছুই জানেনা। যেকোনো ট্রেনই, বিশেষতঃ ব্রীজের ওপর, প্রচণ্ড একা। নিজের অসম্ভব গতি ও অতিকায় স্পেসের জন্য কোনো সঙ্গী ট্রেন হয় না ট্রেনের। হয় একে অপরকে পেরিয়ে যায়, নয়তো মুখোমুখি এলে দ্বিগুন গতিতে অতিক্রম করে। অতিক্রম না করা সঙ্গী হয়না ট্রেনের। এখানেই ম্যাডামের নিজেকে বড্ডো বড্ডো ট্রেন ট্রেন মনে হয়। ট্রেনটা যেন অবিকল তাঁর মতো একা। একটা কোনো প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়াবে একটু জিরোবে, জল খাবে। তখন হয়তো আরেক ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, হাঁফাতে হাঁফাতে জিজ্ঞেস করবে “কি রে কেমন আছিস? তারপর বল কেমন চলছে?” টুকটাক কথায় কথায় হয়তো একটা লাল ট্রেন আরেকটা সবুজ ট্রেনের মধ্যে সামান্য অন্তরঙ্গতা জন্মাবে। অল্প সময় কথা থামিয়ে একে অপরের দিকে বিষ্ফারিত চোখে তাকাবে অপলক। বেচারা দুজনেই শত চাইলেও কাছে আসতে পারবে না, কারন লাইন আলাদা। দুটো অনন্ত বিস্তারী সমান্তরাল রেখা তার পথ হয়ে ফুটে আছে। তার থেকে সরা মানে মৃত্যু। যেখানে নিজেদের পথের মধ্যেই সম অন্তরাল সারাক্ষণ টানা থাকে, সেখানে অন্যের কাছে কি করে আসে? তাও একটু ভাপ যুক্ত নিঃশ্বাস ফেলবে ইঞ্জিন ফোঁস করে। ভাববে ভেঙে ফেলা যায় কি সমান্তরাল রেখাদের নিয়মকানুন। আর ঠিক তখনই হুইশল বেজে উঠবে আর সামনের লাল আলো ডাউন উঠে পড়বে সবুজ। আবার সিটি মেরে ট্রেন এগিয়ে যাবে কোনো ব্রীজের দিকে। এগিয়ে গেলে ফিরেও তাকাবে না পেছনে। কারনা যায় না তাকানো। হুবহু নিজের মতো লাগে ম্যাডামের। কেমন একটা বিষাদিনী বিষাদিনী আনন্দ ঝরঝর করে ওঠে ভেতরে।

রান্নাঘরের দরজা ঠেলতে গিয়ে ওই দূরত্ব কোকিলের কূহুটার হ মিলিয়ে যাওয়া তে ম্যাডাম দাঁড়িয়েছিলেন। একরাশ চিন্তাভাবনা স্মৃতি যেন ঝুপ্পুস করে কেউ ঢেলে দিয়েছে মাথায়। কতো কি যে মনে পড়ে অকারণে। লেখার পর লেখা ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়ে। শব্দ, যারা ম্যাডামের লেখার সাথে সাথে ম্যাডামের সাথেও পরিচিত তারা জানে শব্দের সাথে যেন ঘর করেন ম্যাডাম। উঠতে বসতে খেতে ঘুমোতে নাইতে সবসময় যেন এক শব্দসমুদ্র ওনার সাথে চ্ছলাৎ চ্ছলাৎ করে চলেছে। অনেক অনুরাগী আছে, যারা মাঝে মাঝে সুন্দর শব্দ সাজিয়ে লেখা পাঠায়, চিঠি পাঠায় ম্যাডামকে। ভাবে এতে বুঝি ভারি মুগ্ধ করা যাবে তাঁকে। ম্যাডাম খালি নিজের মনে হাসেন অল্প হয়ে। চোখ বুলোলেই বুঝতে পারেন কি রকম জোর করে টেনে এনে শব্দদের বাক্যে বসানো রয়েছে, যাতে বাক্যটা সুন্দর শুনতে হয়। আর কেউ দেখতে পায়না, ম্যাডাম স্পষ্ট দেখতে পান শব্দগুলো হাত পা বেঁধে বসানোর ফলে কাঁদছে নিঃশব্দে। ম্যাডাম তাদের আলতো করে নিজের হাতে ছাড়িয়ে আনেন বাক্য থেকে। দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন “যাহ, পালা এখান থেকে”। খচর মচর করতে করতে শব্দগুলো পালিয়ে যায়। ম্যাডাম দু কলম উত্তর লেখেন এইসব অনুরাগীদের। আহা, হাজার হোক এরা ওনার লেখা পড়ে লেখার মধ্যে দিয়েই তো ওনার রূপে মুগ্ধ হয়েছে, কতো আগ্রহ হয়তো লিখে পাঠিয়েছে। অল্প কথায় দু তিনটে বাক্য লেখেন “নমস্কার। আপনার লেখাটি পড়লাম। ভালো হয়েছে। আমার লেখা ভালো লাগে জেনে খুব খুশী হলাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। লিখবেন” এটুকুই। এতেই কি খুশী হয়ে যায় তারা। এমনিতেও ভিড় ভালো লাগে না ম্যাডামের। তবে লেখার প্রশংসা করলে তো ভালো লাগেই। সেটা অস্বীকার করেন কি করে। একসময় খারাপ বললে খারাপও লাগতো। আজকাল আর কেউ খারাপ বলে না ম্যাডামের লেখাকে। ওটা নিয়ে খুব একটা দুঃখ হয় না। উনি তো ভালো খারাপের জন্য লেখেন না। আর বহুদিন হয়ে গেল নিজেই বুঝতে পারেন স্পষ্ট একটা লেখা কোথায় নেমে গেছে বা ঝুলে গেছে, বা একটা লেখা কোথায় উঁচু ছুঁয়েছে। নিজেই বুঝতে পারেন সব। একটা বাচ্চা প্রায়ই ওনাকে অনেক অনেক লিখে পাঠায়। তার লেখা পড়তে ভারি মজা লাগে ম্যাডামের। এক্কেবারে বাচ্চা, হাপুস হুপুস করে লেখে। অন্য সবার কাছে অল্প কথার মানুষ হলেও বাচ্চাটার কাছে ম্যাডাম অনেক কিছু বলেন। বাচ্চাটা গম্ভীর গম্ভীর মতামত দেয়। আপা বলে ডাকে। খুব হাসেন ম্যাডাম মনে মনে। এই ভাবনা থেকে সেই ভাবনা হতে হতে আবার ম্যাডাম রান্নাঘরের দরজাটা ঠেলার আগে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়েন। ক্লান্ত হাঁফানো কোকিলটা যেন তার সমস্ত শক্তি জড়ো করে আর্তনাদের মতো ডেকে ওঠে

“কূউউউউউউউউউউউউউউউহু……”। কূহুখেলা কূহুখেলা করে, খুব বসন্ত বিহুল হয়েছে, লাইনটা ঘুরে বেড়ায় হঠাৎ। দুপুর জাতীয় সময়। আদুরে রোদটা এখনো করিডোরে পড়ে আছে। করিডোর শব্দটা মাথায় আসতেই করজোড়ে করজোড়ে শব্দটা মাথায় ঘুরে আসে। মাথা এতই বদবুদ্ধিওয়ালা একটা লোক, যে সে করজোড়ে শব্দটা আসতেই একপলকের জন্য করো জোরে ভেবে ফেলে। ম্যাডামের মুখটা চকিতের জন্য রাঙা হয়ে যায়। আপন মনেই “দূর, দুষ্টুমি সবসময়” বলে ওঠেন। কাকে যে বললেন। আবার “কূউউউউউউউউউউউহু” ডাক ভাসে। আর সেই সময়টা মনে পড়ে ম্যাডামের। সেটাকে বলা হতো ফেসবুক সাহিত্যের সময়। এখনকার মতো ফেসবুক অতো স্পনসর কমার্শিয়াল, প্রফেশানাল ফেসবুক রাইটার সার্ভিস, ইত্যাদি জিনিসের নামগন্ধও ছিলো না। প্রচুর লোক তখন বাংলায় বাংলায় সত্যি নিজের লেখা লিখতো। সে এক গমগমে সময় বটে। অনুপম মুখোপাধ্যায়, কবি আর কোবি বলে কতো কিছুই না লিখতো। কতো বিতর্ক, ম্যাডামের মনে পড়ে। এক পলকের মধ্যে আবার কোথায় ডুবে যান। কতো লেখক, তনভীর হোসেন, মিলন চট্টোপাধ্যায়, অত্রি ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের আকাশলীনা, কচি রেজা। কতো লোক লিখতো। কতো ম্যাগাজিন, অনুপমের বাক ছিলো, আরেকজন অমিতাভ নিজেকে লেখাম্যান বলে অনেক কিছু প্রায়ই লিখতো, গল্পের গ্রুপ ছিলো, কবিতার গ্রুপ ছিলো। ম্যাডামও লিখতেন। বিতর্কে থাকতেন না কোনোদিন, ভালোও লাগতো না ওনার। নিজের লেখা নিয়েই মগ্ন থাকতেন আর হ্যাঁ পড়তেন প্রচুর। আলাপ হতো দুচার জনের সাথে। রত্না, বেবী সাউ, এলোমেলো টুম্পা, এরকম অনেকে এই বাংলায় লিখতো। উষসী ছিলো। ওই লেখাম্যান, আকাশ ইন্দ্রজিৎ দত্ত, সুহান ব্যানার্জী, অর্ঘ্য বক্সী এদের সাথে আলাপও হয়েছিলো ওনার অল্পস্বল্প। লেখাতে যেমন দেখায় এমনিতে মানুষগুলো মোটেই সেরকম নয়। লেখাম্যানের সাথে তৎকালীন আরেক কবি রঞ্জনা কে জড়িয়ে একটা বিতর্কও হয়েছিলো একটা, যাতে দু একটা কমেন্ট লিখেছিলেন ম্যাডাম, কিন্তু পরে আর লেখাম্যানের লেখা এমন কিছু আহামরি লাগেনি। অনুপমের লেখাও না। সেরকম কারোর লেখাই অতো দাগ কাটার মতো লাগতো না। ওনার কোনো ছুঁৎমার্গিতা নেই কোনোদিন। যেমন লেখাম্যানের কবিতা ভালোলাগতো, একইরকম শ্রীজাতর লেখাও। অনেকে এটা আবার বুঝতে পারতো না। আরে কার লেখা ভালো লাগবে, কার লেখা ভালো লাগবে না, এগুলো কি আগে ঠিক করে নিয়ে পড়া যায় কখনো? এই অনুপম, লেখাম্যান, তনভীর, জুবিন, মিলন এদের সাথে সাথে আরেকটা মানুষের কথাও মনে পড়ে ম্যাডামের। ওই ক্ষ্যাপাটার কথা মনে পড়লেই ম্যাডামের কেমন যেন একটা হয় ভেতরে। এদের সবার সব্বার থেকে আলাদা, এক অন্য জগতের লোক ছিলো বোধহয় ক্ষ্যাপাটা। বাচ্চা একেবারে। ম্যাডাম নিজের মনেই হেসে ওঠেন, মুখটা হাল্কা নামিয়ে। কি পাগলাটাই পাগল ছিলো লোকটা। লোক তো নয়, একটা জ্যান্ত ভূত যেন। আর একবার ক্ষেপে গেলেই হয়েছে। আতংক মানে আতংকের ঠাকুর্দার জন্ম দিয়ে দিতে পারে। একের প্র এক মেসেজ, একের পর এক। টাকা ফুরিয়ে গেছে, তাই ফ্রি এস এম এস সার্ভিস থেকে একের পর এক একলাইনের মেসেজ এসেই যাচ্ছে এসেই যাচ্ছে। উফফফ সে দিন গেছে এক একটা। ফোন বন্ধ করার সুযোগ পেতেন না, টুঁ টুঁ করে বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মেজাজ হারিয়ে যা নয় তাই বলে দিতেন। আর বললেই স্পষ্ট বোঝ যেত ওদিকে রেগে তুতলে তাতলে একাকার অবস্থা। আবার উলটে ধমক আসতো “কেন পড়ছেন আমার মেসেজ? আপনাকে পড়তে বলেছি?”…… বোঝো কান্ড, আমার ফোনেই মেসেজ পাঠাচ্ছে দিয়ে আমাকেই বলছে কেন রিসিভ করছেন মেসেজ? হিহিহিহি। বদ্ধ ক্ষ্যাপা একেবারে। চিঠি লিখতো প্রচুর। আসলে লোকটার কোনো বন্ধু ছিলো না। ম্যাডাম বুঝতেন, এইসব লোকেরা মানে ওই ফেসবুক সাহিত্যের লোকজন বেশ নিজেদের গ্রুপ গুছিয়ে নিয়ে দলবল নিয়ে থাকতো। আর এই লোকটা ছিলো একা। আপাদমস্তক একা। একা, একা, একা… শব্দটা ম্যাডামের মাথার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে যেন কোনো এক আলো তৈরী করে যাচ্ছিলো শেষ বিকেলের। রান্নাঘরের ভেজানো দরজা তখনো ভেজানো রয়েছে। রান্না করে খেয়দেয়ে, একটু গড়িয়ে আজকে রাত্রের মধ্যেই বাড়ি ফিরবেন। মানে নিজের একার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি। কিছু কাজ আছে। এসবের মধ্যে ক্ষ্যাপাটার কথা কেন মাথায় এলো? ওর জন্য একসময় আতঙ্কে, টেনশানে, খারাপ লাগায় জীবনের ৭৫% এনার্জি যেন বেরিয়ে গেছিলো। লেখা আটকে যেত মাঝে মাঝে। চরম ঝগড়ার পর ঝগড়া। আর রেগে গেলে ওর হুঁশ থাকতো না, রাগ বলা ভুল, উত্তেজিত হলে। কসাই এর মতো নির্মম আঘাত করতে পারতো। নিজে ভুলে যেত পরক্ষণেই, কিন্তু ম্যাডাম ভুলতে পারতেন না। অনেকদিন, তার অনেক পর অবধি এফেক্ট থাকতো। আর তার ঝক্কি পোয়াতে হতো ম্যাডামের আশেপাশের মানুষদের। এইটাই ম্যাডামের কাছে রাগের ছিলো খুব। প্রতিবার ভাবতেন, এই হয়েছে আর নয়, এবার জীবনে শান্তি থাক, নিজের লেখা নিয়ে থাকবো, কার কোথায় কি পাগলামো সে নিজে বুঝুক। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই নিশির ডাকের মতো ডাক আসতো যেন। ফেসবুকে অনুপম লেখাম্যান, অদিতি, উর্ম্মি, রত্না, এদের প্রোফাইলের পাশাপাশি ওর প্রোফাইলেও গিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারতেন। কখনো দেখতেন এক দুটো নতুন লেখা। পড়লেই ম্যাডামের কেমন হু হু করে উঠতো। কখনো পড়ে বুঝতে পারতেন লোকটা খুব মনখারাপে আছে। একছুটে দৌড়ে যেতে ইচ্ছে করতো তখন। খুব ইচ্ছে হতো ম্যাডামের ওর সমস্ত মনখারাপ একটা ভেজা ডাস্টার দিয়ে মুছিয়ে দিতে। ফেসবুক মহলে, বাংলা সাহিত্য মহলে খুব একটা ভালো নামতো ছিলোই না লোকটার, বরং বদনাম ছিলো। মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে মেয়েদেরকে ফাঁসানোর জন্য, বা নানান চমক তৈরী করার জন্য। ম্যাডাম যেন পরিষ্কার দেখতে পেতেন ক্ষ্যাপাটাকে। বুঝতে পারতেন ওটা একটা দেখতেই বড়ো, আসলে খুব ছোট্ট একটা বাচ্চা। যে নিজের মতো গল্প বানিয়ে বলে খুব মজা পায়। নিজেকে বিরাট বিরাট হীরোর মতো ভাবে। ম্যাডামের হাসি পেত আর আকন্ঠ স্নেহ, যখন বকবক করেই যেত করেই যেত লোকটা। আহারে কেউ ওর কথা শোনার নেই বেচারা, ভাবতেন ম্যাডাম। ম্যাডামের জন্য পুরো পাগল ছিলো ক্ষ্যাপাটা। নিজেই ঝগড়া, দিয়েই নিজেই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতো। আরেকটা জিনিস টের পেতেন ম্যাডাম, কি অদ্ভূত আগলে রাখতো লোকটা নিরুচ্চারে। অনেক অনেক দোষ ছিলো ওর কিন্তু তাঁর প্রতি ওর ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলো না জানতেন ম্যাডাম। এই ভেতরে এসে পড়া ছোট্টো রোদের বৃত্তটার মতো ওই ক্ষ্যাপাটাও অতিকায় রোদের মতো আগলে ম্যাডামের মনের মধ্যে একটু ফাঁক ফোঁকর সহ বৃত্তাকার ছোট্ট একফালি জায়গা পড়ার মতো পেলেই খুশী থাকতো খুব। কিন্তু বড্ড অশান্তি, বড্ড অস্থির আর অসহ্য পরিমাণ তীব্রতা। সে নেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই এক সময় গিয়ে আক্ষরিক অর্থে আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ফেসবুক ইত্যাদি। কিন্তু ক্ষ্যাপাটার কথা কেন মনে পড়লো হঠাৎ। ও তো অনেকদিন হয়ে গেল………

আধখাওয়া ভাবনাটাকে নিয়ে রান্নাঘরের দরজাটা অবশেষে নিজের হাতের চাপ দিতেই, সামনের বারান্দা থেকে একটা হাল্কা গম্ভীর আলতো বাচ্চাটে দানাদানা গলার আওয়াজ ভেসে এলো “ম্যা—ডা-আ-আম”… “ম্যাডা-আ-ম”…… “ম্যা-ডা-মা, ও ম্যা ডাম”…… অনেকটা টুকির মতো সুরে। চুলটা ভিজে আছে তখনো, চমকে এক ঝটকায় পেছন ফিরতেই কোঁকড়ানো চুলগুলো ফেরার গতিবেগে মাথার সাথে সমকোন হয়ে চাবুকের মতো ঘুরে গেল। আর চুলের মাঝখান থেকে, শেষ থেকে কয়েকটা জলের ফোঁটা হু হু করে দৌড়ে গেল বাতাস বেয়ে বেয়ে। ছিটকে বেরোলো যেন। জলের ফোঁটাগুলো বেরিয়ে সামনের দরজার ছিটকিনিটা নিজেদের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটা স্বরূপ হাতেই খুলে ফেললো তড়িঘড়ি। চুলগুলো তখন ম্যাডামের ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে। স্ট্যাচু হয়ে আছেন তিনি। এটা কে ডাকলো, না…… জলের ফোঁটাগুলো দরজা খুলে বেরোলো যেখান থেকে ওই অতিশয় দুষ্টুমি ভরা ম্যাডাম ডাক টা এসেছিলো। বেরিয়ে দেখলো গেট অবধি কেউ নেই, আশে পাশে কোথাও কেউ নেই। ম্যাডামের একার বাড়ির একাটার ওপরে এক প্রকাণ্ড রোদ, ফাঁকা, শূন্য সেও একা দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও কিছুই নেই, ফোঁটাগুলো আর চুলে না ফিরে গিয়ে রোদের ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে মেঘের কাছে চলে গেল। কোনো সময় যদি বৃষ্টি হয়, আর সে সময় যদি ম্যাডাম জানলা দরজার কাছে থাকেন, তবে তারা আবার ফিরে আসবে ম্যাডামের কোঁকড়া কোঁকড়া স্নেহভরা একগোছ চুলগুলোতে। ঠিক ফিরে আসবে, নিজেদের মধ্যে একে অপরকে এই বলতে বলতে জলের ফোঁটা গুলো আস্তে আস্তে মেঘের বাড়ির দিকে ভেসে চললো। আসলে ম্যাডামের থেকে দূরে যেতে কেউই চায়না, ওরা তো বেচারা জলের ফোঁটা, ওরাও চায়না, চায় ম্যাডামকে আঁকড়ে ধরে থাকতে। ওরকম চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন বলে ওরাও তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসেছিলো এই ভেবে যে নিশ্চয় এতদিনে ম্যাডামের একজন মানুষ এসেছে, তাকে জাপটে ওরা আবার ফিরে আসবে ম্যাডামের কাছে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে ওই দৈত্যাকার রোদ আর খাঁ খাঁ তাদের শেষ শক্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছিলো। ধরার মতো শেষ অবলম্বনটুকু। আর কিছু করার ছিলো না তাদের , রৌদ্রকিরণের বল্লম নিজ বুকে গেঁথে বাষ্প হয়ে যাওয়া ছাড়া, ওই বাষ্প হয়ে তারা ধীরে ধীরে যখন উঠে যাচ্ছিলো অনেক উঁচুতে কোনো মেঘের কাছকাছি, তখনো তারা একে অপরকে এই বলে সান্তত্বনা দিচ্ছিলো, অল্প দিন বাদেই তো বৃষ্টি হবে। আর বৃষ্টি হলে ম্যাডাম না দেখে, হাত না ভিজিয়ে পারবে না তারা জানে। তখন তারা আবার নেমে এসে অজান্তে ম্যাডামের চুলে ফের জড়িয়ে ধরে বসে ঠাকবে, ঠিক বসে থাকবে। ঠিক বসে থাকবে। এমনি বলতে বলতে ক ফোঁটা জল জলীয় বাষ্প হলো। তার তলায় খানিকটা দূরে সেই করিডোরে ম্যাডাম আবার আনমনে এসে বসে পড়ে থাকা রোদের বৃত্তটায় আস্তে আস্তে হাতের পাঁচটা আঙুল ডুবিয়ে দিলেন। “কিছু বলবি আমাকে? আটকাচ্ছিস কেন, বল? বল না, আমাকে বলছিস তো, এত দ্বিধা কেন?” রোদটা খালি কেঁপেই যাচ্ছিলো, কেঁপেই যাচ্ছিলো।